![]() |
| জলবায়ু সংকটে বাংলাদেশ: বিলীন হচ্ছে শীত, বাড়ছে বিপদ |
বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখন কেবল বিশ্বমঞ্চের আলোচ্য বিষয় নয়; বাংলাদেশের মতো জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশের জন্য এটি বাস্তব অবস্থায় রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জলবায়ু গবেষণা প্রতিষ্ঠান যেমন IPCC, NASA ও World Meteorological Organization-এর সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকা বৈশ্বিক তাপমাত্রা দক্ষিণ এশিয়ার শীতপ্রবণ এলাকা থেকে শীত ধীরে ধীরে বিলীন করে দিচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২১ শতকের শেষভাগে (২০৭০-২১০০) এদেশে শীত ঋতু যেভাবে পরিচিত, তা হয় সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হবে অথবা অত্যন্ত সীমিত সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
জলবায়ু বিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের শীত হারিয়ে যাওয়ার প্রধান কারণ হলো বায়ুমণ্ডলে ক্রমাগত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বৃদ্ধি। কয়লা, পেট্রোলিয়াম, ডিজেল, গ্যাস-সব ধরনের জ্বালানি পোড়ানোর ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইডের মাত্রা অকল্পনীয় হারে বেড়ে গেছে। IPCC-এর Sixth Assessment Report বলছে-এই নিঃসরণ বন্ধ না হলে ২০৭০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা শিল্প-পূর্ব সময়ের তুলনায় ২.৫°C থেকে ৩°C পর্যন্ত বাড়তে পারে। বাংলাদেশ উপকূলীয় ও ব-দ্বীপ অঞ্চল হওয়ায় এই বাড়তি তাপমাত্রার প্রভাব আরও তীব্রভাবে অনুভূত হবে।
গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে শীতকালীন আবহাওয়া পরিবর্তনের যে প্যাটার্ন দেখা গেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক। ১৯৭০-১৯৮০ দশকে ডিসেম্বর–জানুয়ারিতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৬-৮°C পর্যন্ত নেমে যেত, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরে সেই তাপমাত্রা খুব কমই ১০°C এর নিচে যায়। তাছাড়া শীতকালীন কুয়াশার সময়কালও কমে এসেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমান গতি অব্যাহত থাকলে ২০৭০ সালের পর বাংলাদেশে শীত এক মাসও স্থায়ী নাও থাকতে পারে।
শীত কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া সবচেয়ে বেশি পড়ছে কৃষিক্ষেত্রে। বাংলাদেশের রবি মৌসুমের প্রধান ফসল যেমন গম, আলু, মসুর, সরিষা শীত নির্ভর। তাপমাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ফসলের ফলন কমে যাচ্ছে। কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে গমের ফলন প্রায় ১২–১৫% কমে গেছে। যদি শীত আরও কমে যায়, তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গম চাষ প্রায় অকার্যকর হয়ে পড়তে পারে। আলু, পেঁয়াজ, রসুনের উৎপাদনেও বড় সংকট দেখা দিতে পারে।
শারীরিক স্বাস্থ্যেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। শীতকালে শরীর স্বাভাবিক তাপমাত্রায় থাকতে বিভিন্ন রোগজীবাণুর বিস্তার কমে যায়। কিন্তু শীত ছোট হলে বা তাপমাত্রা বেশি থাকলে চোখ-নাক-গলা সংক্রমণ, হিট স্ট্রোক, ডায়রিয়া, ডেঙ্গুর মতো রোগের বিস্তার বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা-শীত হারিয়ে গেলে বাংলাদেশে গ্রীষ্মজনিত রোগ বছরব্যাপী বাড়তে থাকবে।
জলবায়ু পরিবর্তনে বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য ভয়াবহ ঝুঁকিতে। দেশের উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে শীতের সময় পরিযায়ী পাখিরা আশ্রয় নিত-কিন্তু তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তাদের আগমন কমে গেছে। একইভাবে অনেক স্থানীয় উদ্ভিদ ও প্রাণীর প্রজননচক্র শীতের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা ব্যাহত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, উষ্ণায়নের কারণে দেশের প্রাকৃতিক চক্রে অপ্রত্যাশিত রূপান্তর দেখা যাচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম বড় প্রভাব পড়ছে জলসম্পদে। শীত কমে আসলে শুষ্ক মৌসুমে নদীর পানি প্রবাহ কমে যায়, ফলে নদীভাঙন, চর সৃষ্টি ও নাব্যতা সংকট বাড়ে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শীতের বিলীনতা বাংলাদেশের নদী ব্যবস্থাকে আরও অনিশ্চিত করে তুলবে। কৃষি, মৎস্য এবং নৌপরিবহন-সবখানেই এর প্রভাব পড়বে।
বাড়তি তাপমাত্রা বাংলাদেশের নগরজীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলছে। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোর হিট আইল্যান্ড ইফেক্ট ক্রমশ বাড়ছে। শীত না থাকলে শীতল বাতাসের প্রবাহ কমে যাবে, যার ফলে বছরজুড়ে গরম ও আর্দ্রতার চাপ বেড়ে যাবে। এতে বিদ্যুৎচাহিদা বাড়বে, গ্রীষ্মে লোডশেডিং আরও তীব্র হবে এবং কৃষি–শিল্প–গৃহস্থালি সবখানেই চাপ বাড়বে।
শীত কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মৎস্য খাতেও বড় পরিবর্তন আসছে। অনেক প্রজাতির মাছ শীতকালীন তাপমাত্রায় প্রজনন করে থাকে। তাপমাত্রা অস্বাভাবিক হলে মাছের প্রজননচক্র বিঘ্নিত হয়। নদী ও খালে মাছের সংখ্যা কমে যাওয়ায় মৎস্যজীবীদের জীবিকায় সরাসরি প্রভাব পড়ছে। ভবিষ্যতে এটি খাদ্যনিরাপত্তার ওপরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশে শীত হারিয়ে গেলে মানুষের জীবনযাপন পদ্ধতি, কৃষি ক্যালেন্ডার, সামাজিক অনুষ্ঠান, এমনকি ঐতিহ্যবাহী শীতকালীন উৎসব-সবকিছুই বদলে যাবে। পিঠা উৎসব, শীতকালীন গ্রামবাংলার রূপ-এসব সংস্কৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জলবায়ু পরিবর্তন কেবল পরিবেশ নয়, মানুষের সংস্কৃতি ও সমাজকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
বাংলাদেশে শীত হারিয়ে যাওয়ার জন্য দেশে পরিচালিত শিল্প, পরিবহন ব্যবস্থা ও জ্বালানি খাতও দায়ী। বাংলাদেশে এখনও ৭০% এর বেশি শক্তি আসে গ্যাস, ডিজেল, পেট্রোল ও কয়লা থেকে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার এখনো ৫% এর নিচে। এগুলোই তাপমাত্রা বৃদ্ধির মূল কারণগুলোর অন্যতম। উন্নত প্রযুক্তি ও নীতি প্রয়োগ ছাড়া এ সমস্যা সমাধান করা কঠিন।
বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন রোধে যে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে-প্যারিস চুক্তি, COP সমঝোতা-বাংলাদেশ সেগুলোতে সক্রিয়। কিন্তু বড় নিঃসরণকারী দেশগুলো তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণ না করলে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো লাভবান হবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৭০ সালের মধ্যে শীত রক্ষা করতে হলে এখনই কার্বন নিঃসরণ ৪০-৫০% কমাতে হবে।
সরকার ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ ট্রাস্ট ফান্ড (BCCTF) ও NAP/NDC বাস্তবায়নের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করছে। কৃষিতে জলবায়ু–সহনশীল জাত উদ্ভাবন, নদী খনন, সোলার এনার্জি সম্প্রসারণ-এসব উদ্যোগ শীত হারিয়ে যাওয়ার প্রভাব কিছুটা কমাতে পারে। তবে আরও বড় পরিসরে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে শীত যেন সম্পূর্ণ হারিয়ে না যায়, সে জন্য সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ জরুরি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি বৃদ্ধি, শিল্পায়নে কার্বন সীমা, যানবাহনে ইলেকট্রিক সিস্টেম, বনভূমি রক্ষা-এসব উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি জলবায়ু সচেতনতা বৃদ্ধিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম ও স্থানীয় সরকারকে সম্পৃক্ত করা অত্যন্ত জরুরি। আজ সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে আগামী প্রজন্ম একটি শীতহীন বাংলাদেশই পাবে, যা পরিবেশ, খাদ্যব্যবস্থা ও সমাজ-সবকিছুকে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন-যদি বর্তমান প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৭০ সালের পর বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা ৩-৪°C বাড়তে পারে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ। এ অবস্থাকে তারা ‘জলবায়ু বিপর্যয়’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যে সময় একসময় শীত আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ ছিল, ভবিষ্যতে তা কেবল ইতিহাসের পাতায় বা মানুষের স্মৃতিতে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।
বাংলাদেশের জন্য সামনে দুটি পথ-এক, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় এখনই কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া; দুই, নিষ্ক্রিয় থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এক অনিশ্চিত, উষ্ণ ও শীতহীন দেশের মুখোমুখি হতে দেওয়া। বিজ্ঞানীরা তাই বারবার বলছেন-“সময় এখনই। দেরি করলে হবে অপূরণীয় ক্ষতি।”

0 Comments